স্বদেশ ডেস্ক: দুর্নীতির শেষ নেই সিলেট খাদ্য বিভাগে। একেক জন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বদলি ও পদায়নে কোটি টাকার মতো বাণিজ্য হয় এখানে। এতে বাণিজ্যের কারণ কী অনুসন্ধানে জানা গেল ভিন্ন চিত্র। টাকার খনি হচ্ছে কয়েকটি উপজেলা খাদ্য গুদাম। কোটি টাকা ঘুষে বদলি হতে পিছপা হন না ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। বদলি পেলেই এক বছরে দ্বিগুণ হয় লাভের পরিমাণ। সম্প্রতি সিলেট বিভাগের ৮ জন খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বদলি করা হয়েছে। এই বদলিতে লাগামহীন বাণিজ্যের কারণে খোদ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে তোলপাড় চলছে।
সিলেটের উপজেলাওয়ারী খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের হাত ধরেই সরকারের ধান-চাল ক্রয় কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়। ধান ও চাল সংগ্রহের অন্যতম ভাণ্ডার হচ্ছে সিলেট বিভাগ। ধান কাটার মৌসুম শেষে কৃষকদের কাছ থেকে ও পরবর্তীতে বিভাগের প্রায় সাড়ে ৫শ’ মিল থেকে কেনা হয় চাল। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিগত তিন বছরে সিলেট বিভাগে কৃষক পর্যায় থেকে প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার টন ধান ও মিল মালিকদের কাছ থেকে এক লাখ ২০ হাজার টন চাল কেনা হয়।
ধান ও চালের প্রতি টনে ১ হাজার টাকা ঘুষ নেয়া হলে তিন বছরে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা প্রায় ২৫ কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য করেছেন। প্রতি বোরো ও আমন মৌসুম শেষে কৃষক থেকে খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ধান ক্রয় করে থাকেন। কৃষকদের অভিযোগ প্রতি টন ধান সরকারের কাছে বিক্রি করতে হলে টন প্রতি এক থেকে দেড় হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। সংশ্লিষ্ট থানার খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের টাকা না দিলে তারা ধান কেনেন না। এতে বাধ্য হয়ে কৃষক ঘুষ দিয়েই ধান বিক্রি করেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় সিলেট, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জে কৃষক পর্যায়ে ক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। কৃষকরা আন্দোলনে নামারও হুমকি দিয়েছিলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পূর্বের মতো একই হারে টাকা দিয়ে তাদের ধান বিক্রি করতে হচ্ছে। সিলেট বিভাগের মধ্যে সুনামগঞ্জে রয়েছে কমপক্ষে ৩০০ চালের মিল।
এছাড়া. সিলেট ও হবিগঞ্জে রয়েছে ১০০টি করে ও মৌলভীবাজারে রয়েছে প্রায় ৪৫টি মিল। এসব মিলের মালিকরা সরকারী পর্যায়ে চাল বিক্রি করে থাকেন। মিলের মালিকদেরও ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত টন প্রতি চালে ঘুষ দিয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে। সুনামগঞ্জ ও সিলেটের কয়েকজন মিল মালিক জানিয়েছেন, ঘুষ দিয়ে ধান বিক্রি করা হচ্ছেই তাদের নিয়তি। যদি টাকা না দেয়া হয় ট্রাক ভর্তি চাল ফিরিয়ে দেয়া হয়। ফলে বাধ্য হয়ে মিল মালিকরা খাদ্য বিভাগের অনিয়মের মধ্যেই চাল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা মিল মালিক কিংবা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে দালাল শ্রেণি তৈরি করে রেখেছে। তাদের ছাড়পত্র ছাড়া চাল কেনেন না খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। খাদ্য বিভাগের গুদাম পর্যায়ে এটাই হচ্ছে বড় বাণিজ্যের একটি। বিভিন্ন প্রজেক্ট বা দুর্যোগকালীন সময়ে ধান ও চাল বরাদ্দেও টাকার খেলা চলে। এই বাণিজ্যের কারণ কী- অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রতিটি উপজেলার খাদ্য গুদামের কর্মকর্তারা হচ্ছেন টাকার খনি।
তাদের হাত ধরেই হয় মূল দুর্নীতি। এ কারণে খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বদলিতে হয় টাকার খেলা। সিলেট খাদ্য বিভাগের অভ্যন্তরে সব বদলি করতে পারেন আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক। সিলেট বিভাগের খাদ্য পরিদর্শক সমিতিকে সঙ্গে নিয়েই তিনি সম্প্রতি ৮ জন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বদলি করেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন- সাখাওয়াত হোসেন, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খাদিমনগর খাদ্য গুদাম সিলেট, সঞ্জয় মীতৈ, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সিলেট সদর খাদ্য গুদাম সিলেট, শামসুল হুদা ফয়সাল. ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কানাইঘাট সিলেট, আলমগীর কবির, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দোয়ারা বাজার খাদ্য গুদাম সুনামগঞ্জ, আব্দুল হান্নান কামাল, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছাতক সুনামগঞ্জ, বিউটন চক্রবর্তী, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শান্তিগঞ্জ খাদ্য গুদাম সুনামগঞ্জ, দীপক সূত্র ধর, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শ্রীমঙ্গল খাদ্য গুদাম মৌলভীবাজার ও মো. শফিকুল ইসলাম, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, কুলাউড়া খাদ্য গুদাম, মৌলভীবাজার। এই বদলিতে বড় টাকার বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে একসঙ্গে ৮ জনের বদলি নিয়ে খোদ খাদ্য বিভাগের ভেতরেই তোলপাড় হচ্ছে।
এছাড়া, দুই বছরে এক স্থানে চাকরির মেয়াদ পেরিয়ে গেলেও নানা তদবির ও বাণিজ্যের কারণে বদলি করা হয়নি তিন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে। এরা হচ্ছে- সুনামগঞ্জ সদরের মল্লিকপুর খাদ্য গুদামের শাহীনুর রেজা, নবীগঞ্জ খাদ্য গুদামের কর্মকর্তা অলক বৈষ্ণব ও মধ্যনগর খাদ্য গুদামের কর্মকর্তা অবিনাশ চন্দ্র দেবকে। খাদ্য বিভাগের নিয়মের বাইরে গিয়ে তারা দুই বছরের অধিক সময় ধরে দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে মল্লিকপুর খাদ্য গুদামের কর্মকর্তাকে নিয়ে বিতর্ক দেখা দিলেও মন্ত্রীর তদবির ও টাকার বাণিজ্যর কারণে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। বিগত বোরো মৌসুমে মল্লিকপুর এলএসডিতে ৩ হাজার ২৬৯ টন ধান ও ১৫ হাজার ৭১ টন চালসহ মোট ১৮ হাজার ৩৪০ টন খাদ্যশস্য ক্রয় করা হয়েছে। প্রতি টন ধান ও চালে ১ হাজার টাকা ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে প্রায় ২ কোটি টাকা ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে সিলেটের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. মাঈন উদ্দিন জানিয়েছেন, ‘বদলিতে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। বদলি হচ্ছে রুটিন কাজ। কাজের স্বচ্ছতা আনতে বদলি করা হয়। আর ধান-চাল ক্রয়ে টাকা গ্রহণের অভিযোগ থাকলে সেটি ডিসি ফুড বা টিএনওদের দিয়ে কমিটি আছে। সেই কমিটি দেখভাল করে। আমাদের কাছে অভিযোগ এলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’